যেকোন খেলা সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলেই প্রথমেই বলতে হবে খেলাটি খেলতে কী কী সরঞ্জামের প্রয়োজন। ব্যাডমিন্টন খেলায় প্রয়োজন র্যাকেট, শাটল বা কর্ক, নেট, পোস্ট আর কোর্ট।
র্যাকেট বা ব্যাটঃ
একটি ব্যাডমিন্টন র্যাকেটের মূল কাঠামোতে থাকে প্রায় ডিম্বাকৃতি মাথা ও হ্যান্ডেল। হ্যান্ডেলটি শক্তভাবে মাথার সাথে লাগানো থাকে। মাথার অংশটির ফাঁকা জায়গায় আড়াআড়িভাবে সিনথেটিক সুতার কাজ থাকে। আন্তর্জাতিকভাবে র্যাকেটের নির্দিষ্ট মাপ রয়েছে। দৈর্ঘ্য ৬৮ সে.মি. এর বেশি এবং প্রস্থ ২৩ সে.মি. এর বেশি হতে পারবে না। জাল বোনা মাথার দৈর্ঘ্য সর্বাধিক ২৮ সেঃমিঃ চেয়ে বেশি হবেনা এবং জাল বোনা মাথার প্রস্থ সর্বাধিক ২২ সেঃমিঃ চেয়ে বেশি হবেনা।
শাটল বা কর্কঃ
শাটলের দুটি অংশ থাকে। নীচের অংশটি বলের মতো। এটি রাবার বা শোলা দিয়ে তৈরি এবং উপরে চামড়া দিয়ে ঢাকা থাকে। উপরের অংশটি ঘাঘড়ার মতো,পালক দিয়ে তৈরি। নীচের অংশের সাথে উপরের অংশটি সরাসরি সংযুক্ত থাকে। শাটলটির ওজন ৪.৭৪-৫.৫০ গ্রামের মধ্যে হতে হবে। পালক সংখ্যা হবে ১৪-১৬টি।
ব্যাডমিন্টনের নেটঃ
ব্যাডমিন্টন নেট লম্বায় ২.৫ ফুট এবং প্রস্থে ২০ ফুট। নেটের উপরের মাথাটি মাটি থেকে ৫ ফুট ১ ইঞ্চি উচ্চতায় স্থাপন করতে হয়। ব্যাডমিন্টন নেটের উপরের ধার বরাবর ৩ ইঞ্চি চওড়া সাদা ফিতা দিয়ে মোড়ানো থাকে। নেটের ফাঁকের ভিতর দিয়ে শক্ত দড়ি টেনে দুপাশের খুঁটির সাথে বাঁধা হয়।
ব্যাডমিন্টনের কোর্টঃ
ব্যাডমিন্টন কোর্ট আয়তাকার হয়ে থাকে। কোর্টের মেঝে কাঠের হলে ভালো, তবে পিচ্ছিল যেন না হয়। এটি ৪৪ ফুট দৈর্ঘ্য এবং এককের ক্ষেত্রে প্রস্থ ১৭ ফুট এবং দ্বৈতের ক্ষেত্রে ২০ ফুট। কোর্টের রং উজ্জ্বল হতে হবে। সম্পূর্ণ কোর্টটি স্পষ্ট দাগ দিয়ে নির্দিষ্ট করা থাকে। কোর্ট কোন হালকা রঙের হলে দাগগুলো কালো হতে হবে, অন্যথায় দাগের রঙ হবে সাদা। দৈর্ঘ্য বরাবর মাঝখানে একটি দাগ দিয়ে কোর্টকে দুইভাগে ভাগ করা হয়।
ব্যাডমিন্টনের পোস্টঃ
দুইপাশে নেট বাঁধার জন্য দুইটি পোস্ট বা খুঁটি থাকে। খুঁটি দুটি কোর্টের দু’টি পার্শ্বরেখায় দুই মধ্য বিন্দু বরাবর বসবে। এ বিন্দু থেকে উভয় দিকে প্রান্তরেখার সমান্তরালে ১.৯৮ মিটার (৬’৬”) দূরে টানা রেখাদ্বয়কে শর্ট সার্ভিস লাইন বলে। আবার উভয় প্রান্তরেখা থেকে কোর্টের অভ্যন্তরে ০.৭৬ মিটার (২’৬”) দূরে প্রান্তরেখার সমান্তরালে দুটি লাইন টানতে হবে। একে দ্বৈত খেলার জন্য লং সার্ভিস লাইন বলে। শর্ট সার্ভিস লাইন দ্বারা বিভক্ত দু’দিকের দু’টি কোর্টের মাঝ বরাবর পার্শ্ব রেখার সমান্তরালে দু’টি লাইন টেনে রাইট সার্ভিস কোর্ট ও লেফট সার্ভিস কোর্ট নামে দু’টি কোর্ট তৈরি করতে হবে। কোর্টের সকল মার্কিং বা দাগ ৪ সেন্টিমিটার চওড়া হবে।
ব্যাডমিন্টন খেলার নিয়মাবলী
ব্যাডমিন্টন একক বা দ্বৈত যেকোন ভাবে হতে পারে। একক খেলায় দুইজন খেলোয়াড় এবং দ্বৈততে প্রতি দলে দুইজন করে মোট চারজন খেলোয়াড় থাকে।
মোট পাঁচটি পদ্ধতিতে ব্যাডমিন্টন খেলা অনুষ্ঠিত হয়ঃ
১. মহিলা একক
২. পুরুষ একক
৩. মহিলা দ্বৈত
৪. পুরুষ দ্বৈত
৫. মিশ্র
ব্যাডমিন্টন খেলায় খেলোয়াড়ের লক্ষ্য থাকে, র্যাকেট দিয়ে শাটলটিকে এমনভাবে আঘাত করা যেন তা প্রতিপক্ষের কোর্টে গিয়ে পৌঁছায়। এ কাজটিকে র্যালি বলে। একজন খেলোয়াড় যতবার এ কাজটি করতে পারবেন তিনি তত পয়েন্ট অর্জন করবেন। সার্ভিসের সময় সার্ভারের দুই পা মাটি স্পর্শ করে থাকবে। আবার, একপক্ষের সার্ভিস ফল্টের কারণে অন্য পক্ষ র্যালি লাভ করে।
সার্ভিস ফল্টের কারণঃ
- সার্ভিস করার সময় কর্কটি যদি কোনাকুনি ভাবে কোর্টে না পড়ে।
- সার্ভিস করার সময় যদি কোর্ট থেকে যেকোনো পা উপরে উঠে যায়।
- সার্ভিস করার সময় কর্কটি যদি শর্ট সার্ভিস এরিয়ার বা রং সার্ভিস এরিয়ার মধ্যে পড়ে যায়।
- সার্ভিস করার সময় কর্কটি যদি কোর্টের বাইরে চলে যায়।
- সার্ভিস করার সময় কর্কটি যদি হাতে থেকে ছেড়ে সার্ভিস না করা হয়।
- সার্ভিস করার সময় কর্কটি যদি কোমরের উপরে তুলে সার্ভিস করা হয়।
- সার্ভিস করার সময় কর্কটি যদি নেটে আটকে যায়।
- সার্ভিস করার সময় যদি কোর্টের দাগে পা স্পর্শ করে।
- সার্ভিস করার সময় যদি সার্ভিসকারী ইচ্ছাকৃতভাবে বিপক্ষ কোন খেলোয়াড়কে ধাক্কা দেয়।
এসকল কারণেই মূলত সার্ভিস ফল্ট হয়ে থাকে।
মাঠের নিয়মকানুনঃ
১) যে খেলোয়াড় বা দল টসে জয়ী হবে সে বা তারা পছন্দমতো কোর্ট নেবে এবং প্রথমবার সার্ভিস করার সুযোগ পাবে। প্রতিপক্ষ রিসিভার হিসেবে খেলা শুরু করবে।
২) একক ও দ্বৈত উভয় খেলায় সাধারণত ২১ পয়েন্টের ৩টি গেমে একটি ম্যাচ হয়।
৩) প্রতিবার সার্ভ করলে এক পয়েন্ট অর্জিত হয়। যে পক্ষ একটি গেম জিতবে পরের গেমের শুরুতে সেই সার্ভ করবে।
৪) যদি দুজনের পয়েন্ট সমান হয়ে যায়, এ অবস্থাকে ডিউস বলে।
৫) এ খেলায় যেকোন এক পক্ষকে অন্তত দুই পয়েন্টে এগিয়ে থেকে খেলা শেষ করতে হবে। যেমন: ২১-১৯, ২৫-২৩।
৬) সর্বোচ্চ ৩০ পয়েন্টের মধ্যে খেলা শেষ করতে হবে।
৭) সর্বমোট ২০ পয়েন্টের খেলা হলে যে পক্ষ প্রথমে ২ পয়েন্ট লিড নিয়েছিল সেই পক্ষই জিতবে।
৮) সর্বমোট ২৯ পয়েন্টের খেলা হলে শেষে যে ৩০ নং পয়েন্টটি আগে করতে পারবে সেই জিতবে।
৯) একক খেলায় সার্ভিসকারীর পয়েন্ট শূন্য বা জোড় হলে খেলোয়াড়কে তার ডান দিকের কোর্ট থেকে সার্ভিস করতে হবে, আর যদি বিজোড় হয়, তখন বাম দিকের কোর্ট থেকে সার্ভিস করতে হবে। একজন সার্ভার যখন একটি র্যালি জিতবে তখন সার্ভার একটি পয়েন্ট পাবে এবং তারপরে সার্ভার কোর্ট বদল করে সার্ভ করবে। যদি রিসিভার কোনো র্যালি জেতে, তখন সে এক পয়েন্ট পাবে এবং সে তখন সার্ভার হবে।
১০) দ্বৈত খেলায় প্রথমবার সার্ভিসের সময় ডানদিকের খেলোয়াড় কোনাকুনি বিপক্ষের কোর্টে সার্ভিস করবে।
খেলার শুরুতে এবং স্কোর যখন জোড় সংখ্যা হবে, তখন ডানের সার্ভিস কোর্ট থেকে সার্ভ করতে হবে আর বিজোড় হলে বামের সার্ভিস কোর্ট থেকে সার্ভ করতে হবে। সার্ভিং পক্ষ র্যালি জিতলে তাদের স্কোরে এক পয়েন্ট যুক্ত হবে। তখন একই সার্ভার সার্ভিস কোর্ট বদল করে পুনরায় সার্ভ করতে পারবে। সার্ভিং পক্ষ যে কোনো র্যালিতে হেরে গেলে রিসিভিং পক্ষ একটি পয়েন্ট পাবে। তখন রিসিভিং পক্ষ নতুন সার্ভিং পক্ষ হিসেবে খেলবে।
১১) একক ও দ্বৈত উভয় খেলায় কোনো পয়েন্ট অর্জন না করা পর্যন্ত খেলোয়াড়েরা কেউই নিজ নিজ সার্ভিস কোর্ট বদলাতে পারবে না।
১২) সার্ভিস করার সময় শাটল নেটে লেগে প্রতিপক্ষের কোর্টে পৌঁছালেও সার্ভিসটি সঠিক বলে বিবেচিত হবে।
১৩) লিডিং পয়েন্ট ১১ তে পৌঁছালে খেলায় ৬০ সেকেন্ডের একটি বিরতি নেয়া হয়। আবার, পরপর দুটি গেমের মধ্যে ইচ্ছা করলে ২ মিনিটের বিরতি নেয়া যাবে।
১৪) কোন অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার কারণে খেলা বিঘ্নিত হলে আম্পায়ার লেট ঘোষণা করেন। যেমন: রিসিভার প্রস্তুত হওয়ার আগেই সার্ভার সার্ভিস করলে কিংবা উভয় খেলোয়াড় একসঙ্গে আইন ভঙ্গ করলে।
ব্যাডমিন্টন খেলার কৌশল
ব্যাডমিন্টন খেলার কলাকৌশলকে ৪টি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে
১. গ্রিপ
২. ফুটওয়ার্ক
৩. সার্ভিস
৪.স্টোক ও স্ম্যাশিং
১. গ্রিপ বা র্যাকেট ধরাঃ
গ্রিপ র্যাকেট ধরার ক্ষেত্রে কব্জির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। গ্রিপকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে, যেমনঃ
★ফোরহ্যান্ড গ্রিপ
★ব্যাকহ্যান্ড গ্রিপ
ফোরহ্যান্ড গ্রিপঃ
একজন ডানহাতি খেলোয়াড় তার ডানদিক দিয়ে শর্টগুলো খেললে সেগুলো ফোরহ্যান্ড গ্রিপের অন্তর্ভূক্ত। ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনী দিয়ে র্যাকেটের গোড়া এমনভাবে ধরতে হবে যেন ইংরেজি … অক্ষরের মতো দেখায়।
ব্যাকহ্যান্ড গ্রিপঃ
ডানহাতি খেলোয়াড় তার শরীরের বামপাশে যে শর্টগুলো খেলে তা ব্যাকহ্যান্ড গ্রিপের অন্তর্ভূক্ত। প্রকৃত অবস্থান থেকে হাতটি বাম দিকে এমনভাবে ঘুরাতে হবে যেন হাতের বুড়ো আঙ্গুল র্যাকেটের পিছনে আড়াআড়ি ও কোনাকুনি অবস্থানে এবং র্যাকেটের হাতলের শেষ অংশটুকু হাতের তালুর মধ্যে থাকে।
২. ফুটওয়ার্ক বা পায়ের কাজঃ
দ্রুত স্ট্রোক নেওয়ার জন্য ভালো ফুটওয়ার্ক প্রয়োজন। সার্ভ করার সময় খেলোয়াড়ের দু’পা ১৪” থেকে ১৮” দূরত্বে থাকবে। একে স্ট্যান্স বলে।
৩. সার্ভিসঃ
একজন ভালো খেলোয়াড়কে তিন ধরনের সার্ভিস কৌশল জানতে হয়ঃ
১) হাইডিপ সার্ভিস
২) লো-সার্ভিস
৩) ড্রাইভ সার্ভিস
১) হাইডিপ সার্ভিসঃ
খুব উঁচু দিয়ে শাটল বা কর্ক খাড়াভাবে বিপরীত পক্ষের কোর্টের বেজ লাইনের কাছাকাছি ফেললে, তাকে হাইডিপ সার্ভিস বলা হয়। এর উচ্চতা অনেক সময় ২০ ইঞ্চি বা তারও বেশি হয়ে থাকে।
২) লো- সার্ভিসঃ
শাটল বা কর্কটি খুব নিচু দিয়ে বিপক্ষ দলের সার্ভিস এলাকার শট সার্ভিস লাইন দ্বারা যুক্ত কোনায় ফেলতে পারলে একে লো-সার্ভিস বলা হয়।
৩) ড্রাইভ সার্ভিসঃ
নিচ দিয়ে সজোরে শাটলটি পিছনে বা সার্ভিস গ্রহণকারীর ডান বরাবর সার্ভিস করলে একে বলে ড্রাইভ সার্ভিস।
৪) স্ট্রোক বা স্ম্যাশিংঃ
স্ট্রোক বা স্ম্যাশিং করার কৌশলকে মূলত ৬টি ভাগে বিভক্ত করা যায়। এগুলো হল-
ফোরহ্যান্ড স্ট্রোকঃ
ডানহাতি খেলোয়াড়ের বাম পা বা কাঁধ নেটের দিকে রেখে শরীরের ডান পাশ দিয়ে শাটলে আঘাত করতে হয়। র্যাকেট পিছনে নেওয়ার সময় ডান পায়ের উপর দেহের ভর রাখতে হবে এবং শাটলে আঘাত করার সাথে সাথে শরীরের ওজন ডান পা থেকে বাম পায়ের উপর চলে আসবে।
ব্যাকহ্যান্ড শটঃ
ব্যাকহ্যান্ড শটের ক্ষেত্রে ডান কাঁধ ও ডান পা নেটের দিকে রেখে ডানহাতি খেলোয়াড় তাঁর শরীরের বাম পাশ দিয়ে শাটলে আঘাত করবে।
ওভারহ্যান্ড শটঃ
বাম পা সামনে রাখতে হবে এবং ডান পায়ের উপর শরীরের ওজন থাকবে। শট নেওয়ার সময় শরীর পিছনের দিকে একটু ঝুঁকে যাবে এবং মাথার উপর নিয়ে পিছন দিক দিয়ে র্যাকেট তুলে এনে শাটলে আঘাত করতে হবে।
ড্রপ শটঃ
এ শটের ক্ষেত্রে, শাটলটিকে নেটের সামান্য উপর দিয়ে নেট পার করে বিপক্ষ কোর্টে ফেলতে হবে।
আন্ডারহ্যান্ড শটঃ
সার্ভিস করার সময় র্যাকেট স্যুইং করে শাটলে লাগার সাথে সাথে র্যাকেটের গতি রোধ করতে হবে।
স্ম্যাশিংঃ
মাথার উপর শট নেওয়ার কৌশলে র্যাকেট ধরা হাতটি পিছন থেকে সুইং করে উপরে উঠাতে হবে। যে মুহুর্তে র্যাকেট শাটল স্পর্শ করবে, তখনই হাতের কব্জি নিচের দিক করে সজোরে শাটল আঘাত করলে শাটলটি দ্রুত নিচের দিক নেমে যাবে এবং বিপক্ষের কোর্টে গিয়ে আছড়ে পড়বে। এ পদ্ধতিটিকে স্ম্যাশিং বলে।
উপরিউক্ত কৌশলগুলো অবলম্বন করলে আপনি ভালোভাবে ব্যাডমিন্টন খেলতে পারবেন।