রোবট পরিবার!!!

 

১) খোকাবাবু ভেক্টর

খোকাবাবু ভেক্টর রোবট

চিন্তা করুন, পাঁচ কি ছয় আউন্স ওজনের একটা রোবট। আপনার হাতের স্মার্টফোনটির ওজনও হয়তো এই রোবটের চেয়ে বেশি। কিন্তু কথায় আছে “ছোট মরিচের ঝাল বেশি”। প্রবাদটা পুরোপুরি খাটে এই ছোট্ট ভেক্টরের ক্ষেত্রে। ভেক্টরের যাত্রা শুরু মার্কিন রোবট  নির্মাতা প্রতিষ্ঠান “আ্যংকি” (Anki) এর হাত ধরে। রোবটটি এমনভা্বে ডিজাইন করা হয়েছে যে এটি আপনার কথা বুঝতে পারবে, এমনকী সে অনুযায়ী উত্তরও দেবে। শুধু তাই না, ভেক্টরের রয়েছে স্বাধীন চিন্তাভাবনা করার শক্তি। রয়েছে মান-অভিমান। ২০১৮ সালে রোবটটি প্রথম বাজারে আসে। রোবটটি কন্ট্রোলের জন্যে রয়েছে আলাদা অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ। প্রসেসর হিসেবে এতে ব্যবহার হয়েছে Qualacomm 200। উদ্ভাবকদের মতে “Vector is designed for hang out and help out” অর্থাৎ ভেক্টর আপনাকে দেবে একাকীত্ব থেকে মুক্তি আর সহজ জীবনের সন্ধান। নিজের ইচ্ছায় এগিয়ে আসবে আপনার সাহায্যে। তবে সমস্যা একটাই। একবার অভিমান করে বসলে রাগ ভাঙাতে বেগ পেতে হবে। রোবটটি নিজেই নিজেকে চার্জ করতে পারে। এ নিয়ে ব্যবহারকারীর চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। রোবটটির বাজারমূল্য ধরা হয়েছে ১৬২ ডলার। ভেক্টর সম্পর্কে ভোক্তাদের রিভিউও চমৎকার। আপনার ১৬২ ডলার কড়ায়-গণ্ডায় পুষিয়ে দেবে খোকাবাবু ভেক্টর।

২) করোনা ও বুদ্ধিমান রোবটকরোনা প্রতিরোধে বুদ্ধিমান রোবট

বিশ্বজুড়ে থাবা বসিয়েছে মহামারি করোনা ভাইরাস। মানবসভ্যতাকে মারাত্মক ছোঁয়াচে এই ভাইরাস থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবট। জীবাণুনাশক স্প্রে ছেটানো থেকে শুরু করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম রক্ষা, এই সমস্ত কাজের জন্যই রোবট তো আছেই। এক কথায় কোথায় নেই রোবট! মিশরের একদল সাইন্টিস্ট উদ্ভাবন করেছেন রিমোট কন্ট্রোল করোনা রোবট। কোভিড নাইন্টিন রোগীর নমুনা সংগ্রহ এবং পরীক্ষা থেকে শুরু করে রোগীদের সেবা প্রদানের জন্য রোবটটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়াও সামাজিক দূরত্ব রক্ষা এবং জনসমাগম এড়াতে নানাভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে রোবট। প্রতিবেশী দেশ ভারতও পিছিয়ে নেই রোবটের সুবিধা গ্রহণে। দিল্লি, মুম্বাই, কেরালাসহ বিভিন্ন প্রদেশের হোটেলে খাবার পরিবেশনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ওয়েটার রোবট। জার্মানির একদল রোবট নির্মাতা বলছেন,করোনা মহামারী ব্যাপক আকার ধারণ করার পর থেকে হঠাৎ করেই তাদের তৈরিকৃত রোবট এর চাহিদা বেড়ে গেছে। তাদের নির্মিত রোবটগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে মূলত করোনার বিস্তার ঠেকাতে। জার্মানির বিভিন্ন সুপারশপে শোভা পাচ্ছে এই রোবটগুলো। ক্রেতাদের কারো মুখে মাস্ক অথবা হাতে গ্লাভস না থাকলেই সচেতন করছে এই করোনা প্রতিরোধী রোবট। এছাড়া ইদানীং সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে গৃহস্থালির বিভিন্ন কাজকর্মের জন্য চাহিদা বেড়েছে এ ধরনের রোবটের। রোবটগুলো সচেতন করার সাথে সাথে ঘর-বাড়ির বিভিন্ন কাজ করতেও সক্ষম।

৩) বৃদ্ধাশ্রমের রোবট

বৃদ্ধাশ্রমে সেবাদানকারি রোবট

“বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে বেগ কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ” প্রবাদটা হয়তো আমরা অনেকেই জানি। আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের  প্রসারের জন্য মানুষের মধ্যেকার ভালোবাসা আর সম্প্রীতি -সৌহার্দ্য আরো অনেকটাই কমে যাবে বলে অনেকে মনে করেন। তবে বৃদ্ধ বয়সে সন্তান-সন্ততি আর নাতিপুতি থেকে আলাদা হয়ে নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে কাটাতে যখন জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে যায়, কেমন হয়, তখন যদি একটা রোবট ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেয়! কেমন হয় যদি বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যোগায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স! আবার ঘুরে ফিরে সেই জার্মানি। জার্মানির একটি বৃদ্ধাশ্রমেই দেখা মিলেছে এই দৃশ্যের। বয়স্কদের ফরমাশ খাটা, খাবার পরিবেশন থেকে শুরু করে কুশল বিনিময় পর্যন্ত করতে পারে এই রোবটগুলো। জার্মানির বৃদ্ধাশ্রমের এক বৃদ্ধা রসিকতা করে বলেন, “ও যদি শুধু রান্না করতে পারত তাহলে আমি ওকে দত্তক নিতাম” এতই পছন্দ হয়েছে আমার। মাত্র দেড় মিটার উচ্চতার এই রোবটের পারদর্শিতা রয়েছে পরিচ্ছন্নতার কাজেও। তবে বয়স্কদের একাকীত্ব ঘুচাতে এবং মানসিকভাবে চাঙ্গা করতে জুড়ি নেই এদের। এ প্রকল্পের উদ্যোক্তা ম্যাথিয়াস হফাস জানান, “ওল্ড হোমের কর্মীদের ওপর থেকে চাপ কমানোর জন্য ২০১৮ সাল থেকেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এ ধরণের রোবট নির্মাণের”। করোনা মহামারীর কারণে আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে রোবটগুলো। কারণ মানুষের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে, যে ভয় রোবটের মধ্যে নেই। তিনি আরো জানান, এ রোবটগুলো বয়স্কদের দেহের তাপমাত্রা মাপতে পারে, এমনকি তাদের বিভিন্ন ধরনের থেরাপি দেয়ার সক্ষমতা রয়েছে রোবটগুলোর। একাকীত্বে ভোগা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের খানিকটা হলেও আনন্দ দিতে পারাটাই তাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া।

৪) সুন্দরী সোফিয়া

কৃত্তিম বুদ্ধিমান রোবট সোফিয়া

রোবট সোফিয়ার কথা মনে আছে কি? বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলা এই কৃত্রিম বুদ্ধিমান নারী রোবটটি ঘুরে গিয়েছিল বাংলাদেশও। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল সোফিয়া। এমনকি তার সাথে রসিকতায় মেতে উঠেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোফিয়াকে বলা হয় বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান রোবট। এর নির্মাতা হংকংভিত্তিক রোবটিক প্রতিষ্ঠান হেক্সন রোবটিকস। সোফিয়াকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে সে মানুষের সাথে সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং নিজে থেকেই মানুষের ব্যবহার শিখতে পারে। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে সোফিয়া সর্বপ্রথম সক্রিয় হয়। সোফিয়ার চেহারা নকশা করা হয় অভিনেত্রী অড্রই হেপ্পানির আদলে। সোফিয়ার চামড়া সিলিকনের তৈরি। তাই অনেকটা মানুষের চামড়ার মতই দেখায়।

নির্মাতাদের মতে সুফিয়া মানুষকে আলাদাভাবে চিনতে পারে এবং তাদের অভিব্যক্তি নকল করতে পারে। মুখে প্রায় ৬২ ধরনের অভিব্যক্তি ফোটাতে পারে সে। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে এবং সামনের মানুষের সাথে কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে সোফিয়া সময়ের সাথে সাথে নিজে নিজেই আরো বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে। সোফিয়ার বুদ্ধিমত্তার সফটওয়্যার ডিজাইন করে “সিঙ্গুলারিটিনেটেড” নামে একটি সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। সোফিয়া মূলত এলিজা নামক অন্য একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমান রোবট এর আপডেটেড ভার্সন। এলিজা রোবটটি সর্বপ্রথম রোবট যেটি মানুষের সাথে কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারতো। অল্প সময়ের মধ্যে সোফিয়ার অর্জনও কিন্তু কম নয়। সোফিয়াই প্রথম রোবট যার কোন দেশের নাগরিকত্ব রয়েছে। অনেকেই হয়তো জানেন, ভিন্ন কোন দেশে জন্ম নেওয়া মানুষের জন্য সৌদি আরবের নাগরিকত্ব পাওয়া কতোটা দুষ্কর। আর এই কাজটি করে দেখিয়েছে সোফিয়া। সৌদি আরবের নাগরিক হিসেবে সে এমন অনেক সুবিধা পাবে যা সেই দেশের নারীদেরও নেই। সোফিয়ার গুণে মুগ্ধ হয়েই কিনা সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবে গড়ে তুলতে যাচ্ছেন রোবটিক মেগাসিটি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এই শহরে মানুষের চেয়ে রোবটের সংখ্যা থাকবে বেশি। এ শহর নির্মাণে বেশ আগ্রহী প্রিন্স সালমান। সম্প্রতি, তিনি আলোচনার জন্য ইলেকট্রনিক্সের জন্য জগৎ খ্যাত সিলিকন ভ্যালি ভ্রমণ করে এসেছেন। তবে সোফিয়ার আবিষ্কার কারো কারো কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলতেই পারে । কারণ একটা ইন্টারভিউয়ের এক পর্যায়ে সে বলে ” OK, I WILL DESTROY HUMAN”

(৫) হোন্ডার অ্যাসিমো

কৃত্তিম বুদ্ধিমান রোবট আ্যসিমো

প্রযুক্তির উদ্ভাবন আর উন্নয়নে জাপান সবসময়ই থাকে শীর্ষে। তাই এবার আলোচনা করবো বহুল প্রচলিত জাপানের মোটর কোম্পানির হোন্ডার Asimo রোবটটি নিয়ে। ১৯৭০ সাল থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবট তৈরীর চেষ্টা করে আসছে কোম্পানিটি। অ্যাসিমোর আগেও কিছু ছোট ছোট রোবট তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সর্বপ্রথম, তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল হাঁটতে সক্ষম একটি রোবট তৈরি করা। এ লক্ষ্যে ১৯৮০ সালে প্রথম তৈরী হয় E3 নামে দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি রোবট, যেটি হাঁটতে সক্ষম। ক্রমাগত গবেষণার সর্বশেষ রূপ হচ্ছে অ্যাসিমো। E3 ও অ্যাসিমোর মাঝেও বেশ কয়েকটি রোবট বাজারে আনে হোন্ডা। নির্মাতারা জানান এই রোবট তৈরির উদ্দেশ্য কেবলই মানুষকে সহায়তা করা। 119 পাউন্ড ওজনের এই রোবটটির উচ্চতা 4 ফুট 3 ইঞ্চি। রোবটটি চলে লিথিয়াম ব্যাটারিতে। এতে সংযোজিত আছে আইসি কমিউনিকেশন কার্ড। ঘণ্টায় প্রায় ৬ কিলোমিটার দৌঁড়ানোর সক্ষমতা রয়েছে অ্যাসিমোর।

রোবটটি প্রথম আলোচনায় আসে ২০০০ সালে। তবে বিগত ২০ বছরে রোবটটিকে আরো অনেক আধুনিক করা হয়েছে। এর সর্বশেষ হালনাগাদ করা হয় ২০০৯ সালে। রোবটটিকে কিভাবে আরো বেশি আধুনিক করা যায় সে বিষয়ে গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। রোবটটি খুব কম সময়ে অত্যন্ত বিখ্যাত হয়ে যাওয়ায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের বিজ্ঞাপনে রোবটটির ব্যবহার শুরু করে। তাই নাম না জানলেও রোবটটির চেহারা হয়তো অনেকেই চিনে থাকবেন। অন্যান্য রোবটগুলোর মতো এই রোবটটিও মানুষের চেহারা এবং গলার স্বর আলাদা করে চিনতে পারে। মানুষের মুখ ভঙ্গি, অঙ্গভঙ্গি এবং মনোভাব বোঝার ক্ষমতা রয়েছে অ্যাসিমোর। গেল নভেম্বর মাসের ২১ তারিখ ছিল অ্যাসিমোর ২০তম জন্মদিন। তবে অ্যাসিমোর গুণে মুগ্ধ হয়ে একে কেনার কথা ভাবার আগে ২৫লক্ষ ডলার জমা করতে ভুলবেন না যেনো! বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে এই রোবটটি বিক্রি বন্ধ রয়েছে। তবে প্রদর্শনীতে প্রায়ই দেখা মেলে অ্যাসিমোর।

৬) চাইনিজ জিয়াজিয়া

কৃত্তিম বুদ্ধিমান রোবট চাইনিজ জিয়াজিয়া রোবট

বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তিখাতে সবচেয়ে দ্রুত উন্নয়নশীল দেশটি হচ্ছে চায়না । তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে চীনের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে  চীনে প্রদর্শিত হয় একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবট। এর নাম জিয়াজিয়া। জিয়াজিয়ার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান “University of Science and Technology of China ” রোবট সোফিয়ার মতো এটিও একটি মেয়ে রোবট। সৌন্দর্যের বিচারে হয়তো সোফিয়ার চেয়ে বেশখানিকটা এগিয়ে থাকবে জিয়াজিয়া। ২০১৬ সালে জিয়াজিয়া সর্বপ্রথম জনসমক্ষে আসে। চীনের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর জগতে এটি প্রথম রোবট যেটি মানুষের সাথে মিথস্ক্রিয়া করতে সক্ষম। জিয়াজিয়ার সাথে সোফিয়ার অনেক মিল পাওয়া যায়। এটি মূলত তৈরি করা হয়েছে মানব-মস্তিষ্ককে বিচার করার জন্য। মানুষের মুখের অঙ্গভঙ্গির সূক্ষ্ম পার্থক্য বিশ্লেষণ করে এটি মানুষের চরিত্র এবং অন্যান্য বিষয় শিখে নেয়ার চেষ্টা করে। তৃতীয় প্রজন্মের এই রোবটটি সাধারণত চাইনিজ ট্রেডিশনাল ড্রেসআপে জনসম্মুখে আসে।

অন্যান্য মেয়ে রোবটের মতো এই রোবটটির চামড়াও তৈরি করা হয়েছে সিলিকন দিয়ে। তবে এক দৃষ্টিতে দেখলে বিশ্বের অন্যান্য যে কো্নো রোবটের চেয়ে বেশি মানবীয় বলে মনে হয় জিয়াজিয়াকে। গবেষকদল জানান জিয়াজিয়া চীন এবং চীনের বাইরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আবিষ্কারকরা জানান,”যখনই জিয়াজিয়া কোন প্রদর্শনীতে যায় তখনই তার সাথে সেলফি তোলার জন্য ভিড় জমে যায়।” এই ভীড় সামাল দিতে প্রায়ই বেগ পেতে হয়। জিয়াজিয়ার সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে তারা আরো নতুন নতুন রোবট তৈরি করার চিন্তা করছেন বলে জানান। রোবটিক্স হাতের মুঠোয় এনে দেয়াই তাদের মূল লক্ষ্য। তবে বেশ কিছুদিন ধরে জিয়াজিয়া জনসম্মুখের আড়ালে রয়েছে। রোবটটির যান্ত্রিক পরিবর্ধন এবং পরিবর্তনের জন্য কাজ করা হচ্ছে। রোবটটি কখনো বাণিজ্যিকভাবে বাজারে ছাড়া হয় নি। তবে ধারণা করা হয়, কখনো রোবটটিকে বাজারে ছাড়লে এর বাজার মূল্য ১০ লাখ ডলার ছাড়াবে।

৭) ট্রান্সফর্মার T9

কৃত্তিম বুদ্ধিমান ট্রান্সফর্মার T9 রোবটআর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যে শুধু বড়দের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে তা কিন্তু নয়। আপনার শিশুকে যদি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চান তাহলে আপনার জন্য রয়েছে T9 রোবটটি। ছোটবেলায় ট্রান্সফর্মার সিরিজটি দেখেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এর অ্যানিমেটেড এবং মুভি সিরিজ ছিল সমানভাবে জনপ্রিয়। এই ট্রান্সফর্মারকে কল্পনার পাতা থেকে নিয়ে বাস্তবে রূপ দিয়েছে “রোবোসেন অফিশিয়াল” নামক একটি রোবট নির্মাতা সংস্থা। ২০১৯ সালের ১৩ই ডিসেম্বর রোবটটি সর্বপ্রথম বাজারে আসে। রোবটটির ওজন সর্বসাকুল্যে ৩.২৬ পাউন্ড। কেজির হিসাবে যা প্রায় দেড় কেজির মতো। উচ্চতা একফুটের কাছাকাছি। রোবটটি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে অত্যাধুনিক আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি। ব্যবহারকারী ভয়েস কমান্ডের সাহায্যে খুব সহজেই রোবটটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। এছাড়া রোবটিক কন্ট্রোল করতে রয়েছে একটি বিশেষায়িত অ্যাপ। রোবটটির রয়েছে বাইশটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স জয়েন্ট অর্থাৎ উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বাইশটি সার্ভো মোটর।

মোটরগুলোর কারণে রোবটটি অত্যন্ত দ্রুতগামী। রোবটটি মূলত দুটি প্যাডেলের সাহায্যে চলাচল সম্পন্ন করে। রোবটটির রয়েছে অতি উচ্চ স্টোরেজ ক্যাপাসিটি। ফলে রোবটটি একবারে প্রায় ১০ হাজার কমান্ড মনে রাখতে পারে। রোবটটির প্রোগ্রাম পরিবর্তন করাও খুবই সহজ। এছাড়া বিগিনারদের জন্য রোবসন কোম্পানি তৈরি করে রেখেছে রোবসন হাব। ব্যবহারকারী খুব সহজেই সেখান থেকে বিভিন্ন টিউটোরিয়াল ডাউনলোড করতে পারবেন। রোবটটির সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে এটি শিশুদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিভিন্ন কমান্ড একটির পর অন্য একটি ইচ্ছেমতো অপারেট করে বিভিন্ন রোবটিক ড্যান্স মুভমেন্ট তৈরি করা যায়। রোবসেন হাবসেই সকল ভিডিও শেয়ার করা যায়। ফলে শিশুদের মধ্যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ করার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। রোবটটির কাস্টমার রিভিউ অত্যন্ত চমৎকার। আলিবাবায় রোবটটির রেটিং পাঁচে চার দশমিক ছয়। KTLA NEWS তাদের এক প্রতিবেদনে রোবটটিকে ২০২০ সালের শিশুদের জন্য “Must have toy” বলে আখ্যা দেয়। রোবটটির দাম ৪৯৯ ডলার। টাকার অঙ্কে যা দাঁড়ায় ৫৬ হাজার টাকার কাছাকাছি। তবে কিনলে ঠকতে হবে না বলে জানান এক ক্রেতা।

৮) স্পট মিনি

কৃত্তিম বুদ্ধিমান স্পট মিনি রোবট

কুকুর আকৃতির এই রোবটটির জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে। রোবটটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোস্টন ডাইনামিক্স ২০১৯ সালে প্রথম এটি বাজারে আনে। রোবটটি মূলত ব্যবহার হয় কল-কারখানা বা অন্য যেকোনো নির্মাণ সংক্রান্ত কাজে। তবে পরবর্তীতে এর ডিজাইনে এমন পরিবর্তন আনা হয় যে এটি ঘরে কাজও নির্বিঘ্নে করতে পারে। রোবটটির ওজন প্রায় ৬০ পাউন্ড (প্রায় ৩৬ কেজি)। উচ্চতা প্রায় ১মিটার। একবার চার্জ দিলে রোবটটি টানা ৯০ মিনিট দৌঁড়াতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমান এই রোবটটির মূল বিশেষত্ব হলো এর রোবটিক মুভমেন্ট বা চলাচলে। রোবটটির চলাফেরা প্রথম দেখায় যে কাউকেই চমকে দেবে। স্পট মিনি তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে পারে। চলার পথে যেকোনো ধরনের বাঁধা আসলে রোবটটির সেন্সর তা ডিটেক্ট করে ফেলে। রোবটটির চলার গতি অবিশ্বাস্য।

প্রতি সেকেন্ডে এটি অতিক্রম করে প্রায় দেড় ফিট দুরত্ব। গবেষকরা জানান, রোবটটিতে অন্যান্য সুবিধার সাথে সাথে যোগ করা হয়েছে ‘360 Degree Vision’। সাথে সাথে রোবটটিতে আছে অতি শক্তিশালী এনালাইজিং সেন্সর। যেকোনো অবস্থানে নিয়ে গেলেই রোবটটি প্রথম এলাকা সম্পর্কে জরিপ সম্পন্ন করে। তাই অন্যান্য রোবট থেকে এই রোবটটির কাজ অত্যন্তু নিঁখুত হয়। বোস্টন ডাইনামিক্স কিছুদিন পরপর স্পট মিনির বিভিন্ন আপডেট পোস্ট করে থাকে। ২০১৮ সালের পোস্ট করা একটি ভিডিওতে দেখা যায় স্পট মিনি দরজা খুলতে শিখেছে। তবে কেউ পেছন থেকে রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছিলো নাকি তা জানা যায়নি। এবার আসি দামের কথায়। যে কেউ এই স্পট মিনিকে কিনতে পারবে না। বোস্টন ডাইনামিক্স এ রোবটটিকে বিক্রি করার আগে রীতিমতো সরেজমিনে তদন্ত করে আসে। যদি আপনার খুব বড় কোনো বিজনেস ইন্ডাস্ট্রি থাকে তবেই এটি কেনার সুযোগ পাবেন। তবে রোবটটির প্রকৃত দাম জানা যায়নি।

৯) নার্স রোমিও

কৃত্তিম বুদ্ধিমান নার্স রোমিও রোবট

কখনো ফ্রেঞ্চ শেখার চেষ্টা করেছেন কি? তালিকার এই পর্যায়ে রয়েছে ফ্রেঞ্চ রোবট রোমিও। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান “আলদেবারান”। রোবটটি ধাপে ধাপে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের গবেষনাগারে তৈরী এবং হালনাগাদ করা হয়েছে। ৫ জন উদ্যোক্তার সম্মিলিত উদ্যোগে প্রায় ১৩ টি ল্যাবরেটরীতে ৮০ জনের অধিক রিসার্চার ও প্রকৌশলীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে রোবটটি তৈরি হয়েছে। ফ্রেঞ্চ ভাষায় রোবটটির দক্ষতা ঈর্ষণীয়। এছাড়াও ইউরোপিয়ান অন্যান্য ভাষায় রোবটটি কথা বলতে পারে। রোবটটির উচ্চতা ১৪০ সেন্টিমিটার এর কাছাকাছি। এই উচ্চতা বিশিষ্ট হওয়ায় রোবটটি দরজা খুলতে পারে, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারে এবং টেবিলে রাখা যেকোনো বস্তু ধরে একস্থান থেকে অন্য স্থানে সরাতে পারে। রোবটটি মূলত তৈরি করা হয়েছে অক্ষম ও দুর্বল মানুষদের সহায়তা করার লক্ষ্যে।

এ প্রজেক্টের একজন গবেষক রেডলফ গেলেন জানান, “আমরা এমনভাবে তৈরী করেছি যে সে নিজে নিজে হাঁটতে পারবে, এমনকি তাদের হাঁটতে সাহায্য করবে যাদের চলাচলে অসুবিধা হয়,ব্যবহার্য কোন জিনিস এক রুম থেকে অন্য রুমে নিয়ে যেতে পারবে।” অন্য একজন গবেষক জানান, “রোমিও ব্যবহারকারীকে কোনো অ্যাপোয়েন্টমেন্ট থাকলে তা স্মরণ করিয়ে দেবে। এছাড়া কোন ওষুধ কখন খেতে হবে তা রোবটটি নিজের মেমোরিতে সংরক্ষণ করবে। এবং সময় হলে ব্যবহারকারীকে সে ঔষধ নিজ দায়িত্বে খাইয়ে দেবে। “রোবটটি প্রথম বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করা হয় সেসব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে যারা রোবট তৈরিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছেন। এরপর বিভিন্ন হসপিটাল এবং নার্সিংহোমে সেবা দানের জন্য রোবটটি ব্যবহৃত হয়। তবে বর্তমানে ব্যক্তিগতভাবেও এই রোবটটি কিনতে পাওয়া যায়। রোবটটির দাম প্রায় আড়াই লাখ ইউরো। টাকার হিসাবে যা দাঁড়ায় ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

১০) সামাজিক পিপার

কৃত্তিম বুদ্ধিমান সামাজিক পিপার রোবটনামের সাথে কাজের মিল একদম খুঁজেই পাওয়া যায় না এই রোবটটির মধ্যে। নামে পিপার (মরিচ) অর্থাৎ ঝাল হলেও ঝাঁঝের কিছুই পাওয়া যাবে না রোবটটির কাজে। অত্যন্ত কিউট এই রোবটটি তৈরী হয়েছে জাপান ও ফ্রান্সের গবেষণাগারে এই দুই দেশের যৌথ প্রচেষ্টায়। তবে মূল নির্মাতা জাপানের সফটব্যাংক কর্পোরেশন। ৪ ফুট উচ্চতার এই রোবটটির ওজন ২৮ কেজি। এর দেহে লাগানো আছে বিভিন্ন ধরনের সেন্সর। যার মধ্যে টাচ সেন্সর, সোনার সেন্সর, জেরো সেন্সর, লেজার সেন্সর, বাম্পার সেন্সর অন্যতম।

রোবটটিকে পাওয়ার দেয়ার জন্য ব্যবহার হয়েছে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি। প্রসেসর হিসেবে রয়েছে NAOQI OS অপারেটিং সিস্টেম। রোবটটি টানা ১২ঘন্টা একনাগাড়ে কাজ করতে পারে। গতিবেগ ঘন্টায় প্রায় ৩ কিলোমিটার। রয়েছে ২০টির বেশি ভাষায় দক্ষতা। পিপার প্রথম জনসমক্ষে আসে ২০১৪ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের বার্ষিক সভায় রোবটটিকে বিশ্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। সেখানে দেখা যায় রোবটটি মানুষের মুখের ভঙ্গি, নড়াচড়া এবং কণ্ঠ বিশ্লেষণ করে আলাপচারিতা চালাতে পারে। এমনকি সেদিন উপস্থিত বক্তাকে মানুষের মতোই জড়িয়ে ধরে পিপার! বর্তমানে পিপার রোবটটি ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিসের রিসিপশনে। বিভিন্ন খেলাধূলাসংক্রান্ত ইভেন্টে রোবটটি চিয়ার লিডার হিসেবেও কাজ করছে। নির্মাতারা জানান,”রোবটটি মূলত ভারি কাজ করার জন্য তৈরী করা হয়নি।

ক্রেতার জীবনকে সহজ- সুন্দর ও আনন্দদায়ক করাই পিপারের উদ্দেশ্য”। রোমিও এবং T9 রোবটের মত পিপারের জনপ্রিয়তাও আকাশচুম্বী। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজারের বেশি পিপার রোবট বিক্রি হয়ে গেছে। অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে প্রথম চালানের ১০০০ টি পিপার রোবট বিক্রি হতে সময় নেয় মাত্র ষাট সেকেন্ড বা এক মিনিট ! ২০১৮ সালের একটি হিসাব মতে জাপানের হাজারেরও বেশি ঘরে রোবটটি সেবা দিচ্ছে। তবে বর্তমানে জাপানের গণ্ডি পেরিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন স্থানেও রোবটটিকে সেবা দিতে দেখা যাচ্ছে। পিপার আর রোমিও কিন্তু খুব ভালো বন্ধু। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবট দুটো পরস্পরের সাথে খুব ভালোভাবেই যোগাযোগ করতে পারে। একটি পিপার রোবট কিনতে ক্রেতাকে গুনতে হয় ১৬০০ ডলার বা প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার মতো। তবে রোবটটি ব্যবহারে কিছু আনুষঙ্গিক খরচও রয়েছে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের হিসাব মতে, তিন বছর একটি পিপার রোবট কেউ ব্যবহার করলে মোট খরচ পড়বে ১৬ হাজার ডলার। বাংলাদেশী টাকায় যার মূল্য দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে বারো লাখ টাকা।

নবীনতর পূর্বতন